Breaking
16 Sep 2025, Tue

কৃষ্ণনগর পাবলিক স্কুলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মজয়ন্তীতে বাংলা ভাষার আলোচনাচক্র

Advertisement

স্টিং নিউজ, কৃষ্ণনগর: সমগ্র বিশ্বের দরবারে যিনি বাংলা সাহিত্যকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন আজ শনিবার তাঁর জন্মদিন। তিনি শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর নন, আপামর বিশ্ববাসীর মনের পরতে পরতে সম্মানের সঙ্গে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি আর কেউ নন সুনাট্যকার, সুগীতিকার, কবি, সাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তার জন্মের পর ১৬২ বছর অতিক্রান্ত। সমগ্র বিশ্বে এই ১৬২ বছর ধরে বিভিন্ন ওঠাপড়া, চাপান-উতোরের বেলা বয়ে গেলেও তাঁর সুরমূর্ছনার পানসি তরী একইভাবে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী” – এই আপ্তবাক্য অবলম্বন করেই কবি নিজ জন্মভূমির শিরে ধারণ করিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্বের কিরীট। সেই কোন যুগ থেকে বাঙালি জাতির আবালবৃদ্ধবনিতা “ধনধান্য পুষ্পে ভরা” গানটি প্রার্থনা সংগীত হিসাবে গেয়ে শুভ সূচনা করেছে বিদ্যালয়ের সুন্দর একটি দিনের।‌


আজ তাঁর জন্মদিনে তাকে স্মরণ করেই CBSE বোর্ডের উদ্যোগে কৃষ্ণনগর পাবলিক স্কুলে Secondary level এর বাংলা ভাষা বিষয়ক দ্বিতীয় আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভাটির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরা। আলোচনা সভাটিতে নদীয়া জেলার বিভিন্ন স্কুলের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকারা অংশগ্রহণ করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করে অনুষ্ঠানটির শুভ সূচনা করেন কৃষ্ণনগর পাবলিক স্কুলের ডিরেক্টর অমিতাভ গুহ। প্রিন্সিপল শংকর প্রসাদ দত্ত তাঁর মূল্যবান বক্তৃতার মাধ্যমে অনুষ্ঠানটিকে পরিপূর্ণতা দান করেন। ‌ তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্য সকলের পাথেয় হয়ে থাক।দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করে বিদ্যালয়ের ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা নৃত্যগীতকলার মাধ্যমে। আলোচনা সভাটিতে নদীয়া জেলার বিভিন্ন CBSE School এর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষিকারা অংশগ্রহণ করেন।


ভাষা নদীর স্রোতের মতো বহমান। আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চৈতালি কাব্যগ্রন্থে লিখেছিলেন, “যে নদী হারায় স্রোতে চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে”। ভাষা যখন রুদ্ধ হয়ে যায় তখন সে হয় প্রাণহীন। বিপন্ন হয় তার অস্তিত্ব। প্রায় ২০০ বছর ইংরেজদের রাজত্বে কাটিয়ে বাঙালিও মননের দিক থেকে হয়ে উঠেছিল প্রাণহীন ও অস্তিত্বহীনের মত। এর প্রথম এবং প্রধান কারণ নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা ও অবহেলা। ছোটবেলা থেকেই আমাদের সবাইকে শেখানো হয়,আমরা যদি নিজের মা-বাবাকে ভালবাসতে না পারি সম্মান করতে না পারি তাহলে পৃথিবীর সবাই আমাদের কাছে অসম্মানিত হবে। মা-বাবা যেমন আমরা তাদের সেই ভাবেই ভালোবাসি। ঠিক একইভাবে তাদের বলা ভাষাকেও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আমরা অস্বীকার করতে পারি না আমাদের নাড়ির টান। তাই অন্য ভাষাকে সম্মান জানাতে গেলে, তাকে নিজের করে নিতে গেলে আগে প্রয়োজন নিজের ভাষাকে সম্মান করা, তাকে আপন করে নেওয়া। ‌এই কারণেই বিগত কিছু বছর ধরে আমরা পালন করে আসছি মাতৃভাষা দিবস। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা ভাষা সপ্তম স্থান অধিকার করেছে। ‌ মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা।


CBSE Board অনুমোদিত বিদ্যালয়গুলিও আজ সরব হয়েছে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষারও বহুলাংশে পরিবর্তন ঘটেছে। বদলেছে তার বাক্যবিন্যাস, পদবিন্যাস। আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি ভাষা শিখনের ক্ষেত্রে LAD (Language Acquisition Device) এর উল্লেখ করেছেন।‌ তার মতে ভাষা শিখন শিশুদের সহজাত প্রবৃত্তি।আমরা শিশুদের মধ্যে এই LAD এর ব্যবহার করি বিদেশি ভাষার ক্ষেত্রে। মাতৃভাষার ক্ষেত্রে আমরা এর প্রয়োগ করি না। ফলস্বরূপ, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আজ আমাদের বাঙালীদের কাছেই হয়ে পড়েছে অপাংক্তেয়। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার প্রকাশভঙ্গিরও বদল ঘটেছে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় চর্যাপদ আবিষ্কারের মাধ্যমে যে বাংলা ভাষার সৃষ্টিমুখ আমাদের গোচরে এনেছিলেন সেই সন্ধ্যাভাষার সঙ্গে বর্তমানের বাংলা ভাষার আকাশ -‌ পাতাল পার্থক্য তৈরি হয়েছে। বর্তমানের অত্যাধুনিক বাংলা সাহিত্যের রূপ – রীতি, আঙ্গিক পিছনে ফেলে এসেছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে। সাহিত্যের মাধ্যমেই ভাষার পরিবর্তনশীলতা, বহমানতা পরিলক্ষিত হয়।
পরিবর্তিত হয়েছে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের বিভিন্ন পদ্ধতি। আজ ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রবর্তিত বর্ণানুক্রমিকতার পরিবর্তে আপন করে নিচ্ছে শব্দানুক্রমিকতাকে। আগে অক্ষর এবং বর্ণ ছিল একে অপরের পরিপূরক। বর্তমানে তা হয়ে গেছে পরস্পরের বিপরীত। অক্ষর হল syllable এবং বর্ণ হল letter। বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক বই আগে শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষাতেই লেখা হতো।

ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বাঙালিরা পিছিয়ে থাকত।‌ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল তার ভগীরথ ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মহাশয়। আজ অনেক বিজ্ঞান বিষয়ক বই বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে। যার ফলে উপকৃত হচ্ছে বহু শিক্ষার্থী। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য জন্য বর্তমানের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্রযুক্তির। আজ আমরা কাগজ কলমে লিখতে যতটা না অভ্যস্ত তার থেকে অনেক বেশি সহজ মনে হয় মোবাইলে বা ল্যাপটপে লেখা। এই ল্যাপটপে বাংলা লেখার জন্য আবিষ্কার হয়েছে অভ্র, লিপিঘর ইত্যাদির মত বিভিন্ন software।‌ বিশ্বায়নের যুগে বাংলা ভাষাকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানীয় করে তুলতে হলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমেই তা সম্ভব।

এই কারণেই CBSE Board ইংরেজি ভাষাকে প্রাধান্য দিলেও বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তাদের এই গঠনমূলক প্রকল্প বাস্তবে রূপায়ণের যে কর্মসূচি তারা গ্রহণ করেছেন – তা একটি ভাষাকে পুনরায় সকল দেশের, সকল স্তরের, সকল মানুষকে সমৃদ্ধ করে তুলবে। তারা চেষ্টা করছেন বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে সর্বান্তকরণে বাঁচিয়ে রাখতে। সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের আবেদন, কবি ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের মত কোন কবিকে যেন দুঃখের সঙ্গে, মরমে মরে গিয়ে বলতে না হয় ,
“জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না”।

Advertisement
Advertisement
Advertisement
Developed by